নেতৃত্ব
বা নেতৃত্বদান এবং একজন নেতা
তোমরা নিশ্চয়ই শ্রেণীকক্ষে
তোমাদের দলনেতা নির্বাচন করেছ। অথবা ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে গিয়ে দলনেতা ঠিক করেছ।
তোমরা তাহলে নিশ্চয়ই “নেতৃত্ব” বা “নেতৃত্বদান”
শব্দটি শুনে থাকবে আশা করি। নেতৃত্ব বা নেতৃত্বদান দুটোর অর্থ কিন্তু
একই। আমাদের রোজকার জীবনে আমরা অনেকবার-ই শুনে থাকি শব্দটটা। “নেতৃত্ব”- আমাদের সমাজব্যবস্থার একটি অতি পরিচিত
শব্দ। “নেতৃত্ব” শব্দটি আসলে বিশ্ব
সমাজব্যবস্থার-ই বহুল আলোচিত শব্দ। আচ্ছা, শব্দটি তো কত
সহজেই আমরা উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা কতটা সহজ বা কঠিন?
একটু ভাবো তো!
উত্তর পেলে? ধরে নিলাম তোমরা পেরেছো। আচ্ছা,
সহজ মনে হচ্ছে নাকি কঠিন? কঠিন মনে হচ্ছে
তাইতো? কিন্তু কেন? কারন, নেতৃত্ব শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। নেতৃত্বের সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে
দার্শনিকদের মধ্যেই দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলেন যে, নেতৃত্ব
হলো মানুষের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করে যথার্থ লক্ষ্যে পৌঁছানো। আবার কেউ কেউ বলেন
যে, অন্যকে প্রভাবিত করার জন্যে ক্ষমতার ব্যবহার। কি,
আবারো কঠিন হয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা সহজ করে বলছি।
নেতৃত্ব হলো এমন একটি কৌশল যা নিজেকেই আয়ত্ত করতে হয় এবং যার মাধ্যমে একদল মানুষ
একটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রেষণা বা অনুপ্রেরনা লাভ করে।
আচ্ছা, নেতৃত্ব কিভাবে অর্জিত হয়?
প্রকৃতপক্ষে, নেতৃত্ব নিজের রপ্ত করার বিষয়।
নেতৃত্বগুণ কিন্তু সবার মাঝেই থাকে। শুধু সেটাকে আয়ত্ত করার কৌশল জানতে হয়। নিজের
ভিতরে থাকা নেতৃত্বগুণ নিজেকেই রপ্ত করে সেটা বাস্তবিক জীবনে কাজে লাগাতে হয়। আমরা
প্রায়শই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতা কথা দুটি শুনে থাকি। তোমরাও কিন্তু
শুনেছ। নেতা বা নেতৃত্ব বললেই আমাদের মাথায় কিছু নাম ভেসে আসে। যেমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী,
নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির লেনিন প্রভৃতি। তাহলে কি নেতৃত্ব মানে শুধুই রাজনৈতিক? নেতা মানে কি শুধুই রাজনীতির? নাহ। নেতৃত্ব বিষয়টি
তেমন নয়। পৃথিবী জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শত সহস্র নেতা বা নেতৃত্বের উদাহরণ পাওয়া যায় যারা রাজনীতির বাইরের মানুষ।
যেমন, সাহিত্য জগতের উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কিংবা রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, বিজ্ঞান জগতের আইনস্টাইন কিংবা নিউটন, দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, বীর
যোদ্ধা আলেকজান্ডার, দেশ আবিস্কারক ভাস্কো দ্যা গামা,
এমন আরও অনেকে। তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেলে তোমরা যে, নেতা বা
নেতৃত্বের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। নেতৃত্বের বিচরণ সর্ব ক্ষেত্রেই
বিরাজমান।
নেতৃত্বের গুনাবলি কিন্তু
সবার মাঝেই আছে। সর্বক্ষেত্রেই নেতৃত্বের দর্শন পাওয়া যায়। রাজনীতি থেকে কর্পোরেট
জগৎ, কিংবা
খেলাধুলার ময়দান থেকে পরিবার, সব ক্ষেত্রেই নেতা ও নেতৃত্ব
বিরাজমান। হ্যাঁ, এখন তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, পরিবারে আবার নেতা বা নেতৃত্ব কিভাবে বিরাজমান? হ্যাঁ,
কিভাবে? পরিবারে মা কিংবা বাবা, দুজনেই কিন্তু নেতৃত্ব দেয়। বাবা-মা কষ্ট করে উপার্জন করে সংসার চালান,
সংসারের উন্নতি করেন, আবার আমাদের ভবিষ্যৎ
সুরক্ষিত রাখার জন্যে পরিশ্রম করেন। আমরা যাতে ভালোভাবে পড়াশুনা করে একটি সফল জীবন
যাপন করতে পারি তার জন্যে বাবা-মা নিরলস চেষ্টা করেন। তারা আমাদের সুন্দরভাবে
বাঁচার জন্যে যা প্রয়োজন তাই করেন। এক্ষেত্রে তারা পরিবারে যোগ্য নেতা এবং যোগ্য
নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন।
চলো এবার জেনে নেই একজন নেতা
কি, নেতার গুণ কি কি বা নেতৃত্বের গুণ কি কি। নেতা কী? নেতা হলো সেই ব্যক্তি যে
একটি দল বা গোষ্ঠীর, ক্ষেত্রবিশেষে একটি সমগ্র জাতির অধিনস্ত সদস্যদের মধ্যে
ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং একটি নির্দিষ্ট সাধারন লক্ষ্য অর্জনে সকলের উদ্দেশে
প্রয়োজনীয় রূপরেখা ও নির্দেশনা প্রণয়ন করে এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে সর্বদা
প্রচেষ্টা চালান এবং ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকেন। অন্যদিকে, নেতার সমষ্টিগত সকল
সক্ষমতাই একত্রে নেতৃত্ব রূপে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ, নেতার গুণ-সমূহই নেতৃত্ব। নেতৃত্ব
অর্জন করতে হলে নেতৃত্বের গুণগুলো নেতাকে নিজের মধ্যে ধারন করতে হবে। সঠিক
নেতৃত্বের যেমন একটি প্রতিষ্ঠান লাভজনক পর্যায়ে যায়, ঠিক তেমনি সঠিক নেতৃত্বে
ক্ষতির মাঝেও প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে। তোমরা নিশ্চয়ই স্টিভ জবসের নাম শুনেছ। হ্যাঁ,
ঠিক ধরেছ, আমি বিশ্বখ্যাত টেক জায়ান্ট অ্যাপল-এর প্রয়াত সিইও স্টিভ জবসের কথাই
বলছি। অ্যাপল কোম্পানি একসময় দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিল। দেউলিয়া হওয়ার
দ্বারপ্রান্তে অ্যাপল এর দায়িত্ব নেন স্টিভ জবস। এবং তার নেতৃত্বগুণ দিয়ে তিনি
অ্যাপল-কে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করেন। আর বর্তমানে অ্যাপল-এর অবস্থান কি তা
তোমরা সকলেই জানো। একসময় দেউলিয়ার পথে থাকা একটি কোম্পানি আজ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়
প্রযুক্তি কোম্পানি, শুধুমাত্র একটি সঠিক নেতৃত্বের জন্যে।
আমরা ছোটবেলায় একটি গল্প
পড়েছিলাম। তোমরাও পড়ে থাকবে হয়তো। গল্পটির শিরোনাম ছিলো, “Who will bell the cat?” অর্থাৎ
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে। গল্পটির সারসংক্ষেপ এমন ছিলো যে, একটি বিড়ালের অত্যাচারে বাড়িতে থাকা কিছু ইঁদুর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
ইঁদুরগুলো বিড়ালের থেকে বাঁচার জন্যে অনেক পন্থা ভেবেছিল, কিন্তু
একটিও কার্যকরী ছিল না। শেষমেশ তারা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়। বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাধবে কে? মোদ্দাকথা, প্রথম কাজ কে শুরু করবে? নেতৃত্বে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নেতার অন্যতম গুরু দায়িত্ব হলো
নেতৃত্বের প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। এবং একটি উৎকৃষ্ট পন্থা খুঁজে বের করা যাতে
করে বাকিরা ওই পন্থায় কাজ শুরু করে এবং সঠিকভাবে লক্ষ্যে পোঁছাতে পারে। কাজের
সুত্রপাত এবং উৎকৃষ্ট পন্থা খুঁজে বের করা নেতা বা নেতৃত্বের একটি বড় গুণ।
তোমরা তো শ্রেণিতে দলনেতা নির্বাচন করেছ। কেন করেছ? আবার খেলার
মাঠে আমরা দেখতে পাই দলনেতা। কিন্তু কেন? দলনেতার কাজ কি? কেনইবা বা আমরা দলনেতা নির্বাচন
করি? দলনেতা কি তাহলে আলাদা কেউ? নাহ। আমি, তুমি, তোমরা সবাই কিন্তু নেতা। আমরা আমাদের
মধ্যে থেকেই দলনেতা নির্বাচন করি। অর্থাৎ আমরা কয়েকজন নেতা মিলে একজন দলনেতা নির্বাচন
করি। দলনেতা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। নেতা আমাদের সকলের মাঝে
অনুপ্রেরনা তৈরি করে। তোমরা নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই
ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই মূলত বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে
অনুপ্রেরনা যোগায়। সেই ভাষণেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং
জয়লাভ করে। খেয়াল করে দেখো, একজন নেতা তাহলে তার অনুগামীদের, সহযোদ্ধাদের
অনুপ্রেরনা যোগাতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য আত্মবিশ্বাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোন ব্যাক্তি কিংবা সংস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।
একজন নেতা তার নেতৃত্বগুনের মাধ্যমে তার অনুগামীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেন।
‘আমার সামর্থ্য আছে, আমি জিতবো, লক্ষ্যে পৌছাবো’- নেতা এই বিশ্বাস তার মধ্যে ধারন
করে এবং তার অনুগামীদের মধ্যে এই বিশ্বাস স্থাপন করে। একজন উৎকৃষ্ট নেতৃত্ব
সম্পন্ন নেতা তার অনুগামীদের মধ্যে নেতৃত্বের সমন্বয় করেন। একজন প্রকৃত নেতা একটি
স্পষ্ট সাধারন লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণকে ব্যক্তি স্বার্থের
ঊর্ধ্বে নিয়ে যান। একজন যোগ্য নেতা তার নেতৃত্বগুণ ও দূরদর্শিতার সাহায্যে একটি
পরিকল্পিত রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে অবিচল থাকেন। নেতা তার
সততা ও দূরদর্শিতার সাহায্যে সকলের মাঝে প্রভাব বিস্তার করেন। একজন প্রকৃত নেতা
সর্বদা পজিটিভ মনোভাবের হয়ে থাকেন। নেতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে সচেষ্ট থাকেন।
নেতৃত্বের গুনাবলি বিকশিত করার মাধ্যমে নেতা প্রতিনিধিত্ব করার সক্ষমতা অর্জন
করেন। নেতৃত্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সৃজনশীলতা। নেতা তার সৃজনশীলতার
বহিঃপ্রকাশ ঘটান এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেন। নেতৃত্বের প্রয়োজনে নেতা
নমনীয় হোন, আবার নেতৃত্বের প্রয়োজনে কঠোরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সুতরাং, তোমরা বুঝতেই পারছো, পরিবারে বাবা-মায়ের সঠিক দিক-নির্দেশনা ছাড়া যেমন একটি পরিবার চলে না, ঠিক তেমনি সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া একটি দল বা গোষ্ঠী, সংগঠন-ও চলতে পারে না। দল বা গোষ্ঠী বা সমগ্র জাতির উন্নয়ন ও লক্ষ্য পূরণে সঠিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সমাজব্যাবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই সমাজের উন্নয়নের স্বার্থে নেতৃত্বের চর্চা প্রয়োজন। সমাজ বিনির্মাণ ও সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনে তাই নেতৃত্বের চর্চার কোন বিকল্প নেই। তাই আমরা এখন থেকেই নেতৃত্বের চর্চা করবো। কারন, তুমি, আমি, তোমরা সবাই একেকজন নেতা।
Ahmmed Moon

