বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুর পালা বদলে আসে শীত। শীতকালকে বলা হয় পাহাড় ভ্রমণের আদর্শ সময় তাই শীতকালে রাঙ্গামাটির হাজার পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। কুয়াশা মাখা হিমেল পরিবেশ প্রকৃতিকে আরো নবীন করে তোলে। তাই এই শীতে শতশত গাড়ির যান্ত্রিক কোলাহলে ধ্যান ভাঙে গুরুগম্ভীর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের শহর রাঙামাটির। সারাটা শীত মৌসুম জুড়ে যেন উৎসব লেগে থাকে এই ছোট্ট পাহাড়ী মফস্বল শহরটিতে। ১০টি ভাষাভাষীর ১১টি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক কৃষ্টির সংস্পর্শে আসতে হলে আপনাকে শীত মৌসুমেই আসতে হবে রাঙামাটি। রাঙ্গামাটি বেড়াতে এলে হাতে অন্ততঃ দুই দিন সময় নিয়ে আসবেন। তা না হলে ভ্রমন অপূর্ণ রাখার যন্ত্রণা নিয়েই কিন্তু ফিরতে হবে।
রাঙ্গামাটির ভ্রমনপ্রিয় স্থানগুলো
শুভলং
পর্বতপ্রেমী পর্যটকরা যেতে পারেন শুভলং অভিমুখে। পাহাড় হ্রদের নিবিড় নৈকট্যে আপনার মনেও সৃষ্টি করতে পারে ভিন্ন এক অনুভূতি। কিন্তু একটাই র্দূভাগ্য শীত মৌসুমে ঘুমিয়ে থাকে এখানকার পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো। রিজার্ভ বাজার থেকে জাহাজে করে শুভলং যেতে হবে। শুভলং এর পাহাড়ের উপরে উঠে রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারেন।
রাঙ্গামাটিতে আসা পর্যটকদের মূল আকর্ষণ ঝুলন্ত ব্রীজ। নয়নাভিরাম বহুরঙা এই ঝুলন্ত সেতুটি দুইটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের মধ্যে গড়ে দিয়েছে হৃদ্দিক সম্পর্ক। সেতুটি পারাপারের সময় সৃষ্ট কাঁপুনি আপনাকে এনে দেবে ভিন্ন দ্যোতনা। এখানে দাঁড়িয়েই কাপ্তাই হ্রদের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করতে পারবেন। কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ওপারেই রয়েছে আদিবাসী গ্রাম। ইচ্ছে হলেই দেখতে পাবেন আদিবাসী জীবনযাপনের ক্ষয়িষ্ণু চালচিত্র।
এই রাঙামাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাত বীরশ্রেষ্ঠদের একজন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। রাঙামাটি শহর হতে জলপথে একঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত বুড়িঘাটে এই সমাধি অবস্থিত। চারিদিকে কাপ্তাই লেকের নীলজল খেলা করে আর তার মাঝখানে একটি ছোট্ট দ্বীপে ঘুমিয়ে আছেন আমাদের চির স্মরণীয় অসামান্য বীর। দেশপ্রেমিক আর ইতিহাস সচেতন পর্যটকরা এই বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পাবেন অপূর্ব এক সুযোগ।
রাজবাড়ী ও রাজবনবিহার
রাঙামাটি এসে চাকমা রাজবাড়ী আর তদসংলগ্ন রাজবনবিহার দেখতে কিন্তু মোটেই ভুলবেন না। চাকমা রাজার পুরনো বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এবং রাজবনবিহারের মনমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী দেখে আপনি অবাক হবেন বৈকি! এখানে এসে ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দেখা পাবেন। গেরুয়া রঙের কাপড় পরিহিত নির্জনতা প্রিয় এইসব ভিক্ষুকদের জীবনাচরণ সত্যিই অনুসরণযোগ্য।
বিভিন্ন পিকনিক স্পট
রাঙামাটি শহর থেকে আধঘন্টা দূরত্বে অবস্থিত আরণ্যিক পিকনিক স্পট বালুখালী কৃষি ফার্ম, পেদতিংতিং ও টুকটুক ইকো ভিলেজ। এখানে নির্জনতাপ্রিয় পর্যটকদের জন্য রয়েছে প্রায় সকল ব্যবস্থা। এমনকি আদিবাসীদের ঘরের স্টাইলে মাচাং এর উপরে কটেজ।
এছাড়াও আপনি রাঙামাটির যেসব স্থান ঘুরে দেখতে পারেন তা হলোঃ উপজাতীয় জাদুঘর, ডিসি বাংলো, পলওয়েল পর্যটন, বনবিথী, রাঙামাটি বেতার কেন্দ্র, রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রাঙামাটিস্থ টেলিভিশন উপকেন্দ্র, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র (অনুমতি সাপেক্ষে)।
রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকরা যেতে পারেন বাঘাইছড়ির সাজেক উপত্যকায়। এখানে দুর্গম পাহাড় শীর্ষে আরোহণ করার মজাই আলাদা। হাতি দেখতে হলে যেতে পারেন কাউখালী ও লংগদু।
সাজেক ভ্যালি
সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। চূড়ায় উঠতে গিয়ে দেখতে পাবেন মিজোরাম সীমান্তের পাহাড় আর সবুজের মিতালি। কংলাকের চূড়ার উঠে চারপাশে তাকালে সত্যিই ভুলে যাবেন যে আপনি কোনো যান্ত্রিক শহর-নগরের দূষিত বাতাস, শব্দ এবং কর্কট সমাজে জন্ম নেওয়া মানুষ।
মন, প্রাণ, দেহ পুলকিত হবে এক বিশুদ্ধ চিন্তা আর অনুভূতিতে। প্রভাত এবং প্রাতঃবেলায় সূর্যোদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখার সুখানুভূতি আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে হয়ে উঠবেন কবি। অপ্রেমিকও হয়ে ওঠে প্রেমিক। একজন বৃদ্ধও সবুজের সুরা পান করে হয়ে ওঠেন তেজদীপ্ত তরুণ।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় স্থান এই সাজেক ভ্যালি (Sajek Valley)। এটি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এটি ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তবর্তী এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১৮০০ ফুট। এর অবস্থান রাঙ্গামটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি থেকে এখানে যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক। কারণ, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। তাই ভ্রমণ পিপাসুরা দিঘীনালা থেকেই সাজেক যেতে বেশি পছন্দ করেন।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে শ্যামলী, হানিফ, এস আলম, সৌদিয়া ও শান্তি পরিবহনের বাস চলাচল করে। গাবতলী, কলাবাগানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে পরিবহনগুলোর কাউন্টার। ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে চট্টগ্রাম রোড হয়ে কুমিল্লা, ফেনী হয়ে চট্রগ্রামের মিরসরাই দিয়ে খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছায়। এতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টার মতো।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যেতে হবে খোলা জিপে করে, যা চান্দের গাড়ি নামেই পরিচিত। দুই দিনের জন্য ভাড়া করলে আপনাকে গুনতে হবে ৬৫০০-১০,০০০ টাকা। চান্দের গাড়িতে আসন সংখ্যা ১২টি। সাজেক যেতে প্রথমে যেতে হবে দীঘিনালায়। দীঘিনালা নেমে আধা ঘণ্টার জন্য ঘুরে আসতে পারেন হাজাছড়া ঝর্ণা থেকে।
দীঘিনালা থেকে প্রথমে যেতে হবে বাগাইহাট। সেখান থেকে মাচালং হাট হয়ে সরাসরি পৌঁছে যাবেন সাজেকে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক যেতে মোট সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো।
কিভাবে যাবেন রাঙ্গামাটি?
আপনি বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন রাঙামাটিতে আসতে হলে চট্রগ্রামের অক্সিজেন রাঙামাটির বাস টারমিনাল আসতে হবে। এখান থেকে আধা ঘন্টার ব্যবধানে আপনি পাবেন পাহাড়ীকা ও লোকাল বাস সার্ভিস।
পাহাড়ীকা বাসের ভাড়া ১১০ টাকা এবং লোকাল বাসের ভাড়া ৮৫টাকা।
পাহাড়ীকা বাসে সময় লাগে আড়াই ঘন্টা এবং লোকাল বাসে ৩-সাড়ে ৩ ঘন্টা।
সকাল ৭টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত পাওয়া যায় বাস।
এছাড়া যারা আরামদায়ক ভ্রমন করতে চান তাদের জন্য আছে বিলাস বহুল সার্ভিস এস. আলম, ইউনিক, হানিফ ও বিআরটিসি।
এইসকল বাস সার্ভিসের ভাড়া ১০০-১২০টাকা। সময় লাগবে ২.৩০-৩ ঘন্টা।
এছাড়া নিজস্ব গাড়ী অথবা ভাড়া করা মাইক্রো, কার, ক্যাব নিয়েও আপনি আসতে পারেন রাঙামাটি। নিজস্ব গাড়ী নিয়ে আসলে সময় এবং অর্থ দুই’ই সাশ্রয় হবে ।
রাঙ্গামাটির কোথায় থাকবেন
রাঙামাটিতে পর্যটকদের থাকার জন্য বেশ কিছু ভালমানের হোটেল আছে। যেমনঃ হোটেল সুফিয়া, নীডস হিল ভিউ, মোটেল জর্জ, হোটেল গ্রীন ক্যাসেল, শাইনিং হিল গেষ্ট হাউজ, টুকটুক ইকো ভিলেজ, হোটেল আনিকা অন্যতম।
এগুলো মোটামুটি ভালো মানের হোটেল। ভাড়া ৫০০টাকা হতে ২০০০টাকা পর্যন্ত। আবার কমদামী কিছু হোটেলও আছে। যেমনঃ মধুমিতা, সৈকত, শাপলা, ডিগনিটি, সমতা, উল্লেখযোগ্য। এগুলো ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া পর্যটনের রয়েছে নিজস্ব মোটেল। ভাড়া ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। কটেজগুলোর প্রতি রাতের ভাড়া ৩০০০-৫০০০ টাকা। সরকারি বিভিন্ন দফতরের রেষ্ট হাউস, গেষ্ট হাউস এবং বাংলোগুলো নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ এবং অনুমতি সাপেক্ষে ভাড়া দেওয়া হয়।








সাজেক, চান্দের গাড়ি
ReplyDeleteSajek ❣️❣️
ReplyDelete